“ যথাসময়ে পরীক্ষা আরাম্ভ হল এবং যথাসময়ে শেষ হইল । পরীক্ষার ফল জানিবার জন্য সকলে আগ্রহ করিয়া আছে , নন্দও রোজ নোটিশ বোর্ডে গিয়ে দেখে, তাহার নামে সংস্কৃত প্রাইজ পাওয়ার কোনোবিজ্ঞাপন আছে কিনা। তারপর একদিন হেডমাস্টার মহাশায় এক তাড়া কাগজ লইয়া ক্লাসে আসিলেন, আসিয়াই গম্ভীর ভাবে বলিলেন, এবার দুই-একটা নতুন প্রাইজ হয়েছে আর অন্য বিষয়েও কোনোকোনো পরিবর্তন হয়েছে ।“এই বলিয়া তিনি পরীক্ষার ফলাফল পড়িতে লাগিলেন। তাহাতে দেখা গেল , ইতিহাসের জন্য কে যেন একটা রুপার মেডেল দিয়েছেন । ক্ষুদিরাম ইতিহাসে প্রথম হয়েছে । সে – ই ঐ মেডেলটা লইবে। সংস্কৃতে নন্দ প্রথম, ক্ষুদিরামদ্বিতীয় – কিন্তু এবার সংস্কৃতে কোনো প্রাইজ নাই ।
হায় হায় ! নন্দর আবস্থা তখন শোচনীয় ! তাহার ইচ্ছা হইতেছিল সে ছুটিয়া গিয়ে ক্ষুদিরামকে কয়েকটা ঘুঁষি লাগাইয়া দেয় । কে জানিত এবার ইতিহাসের জন্য প্রাইজ থাকিবে, আর সংস্কৃতের জন্য থকিবে না । ইতিহাসের মেডেলটা তো সে আনায়াসের পাইতে পারিত । কিন্তু তাহার মনের কষ্ট কেহ বুঝিল না – সবাই বলিল , “ বেড়ালের ভাগ্যে শিকেছিঁড়েছে – কেমন করে ফাঁকি দিয়ে নম্বর পেয়েছে ।“ দীর্ঘশ্বাস ছারিয়া নন্দ বলিল , “ কাপাল মন্দ !”
(“ নন্দলালের মন্দ কাপাল “ ; সুকুমার রায় )সম্প্রতি নীতি আয়োগ SDG India র তৃতীয় রিপোর্টটি প্রকাশ করলেন । সাসটেনেবেল ডেভেলপমেন্ট গোল রাজ্যদের ক্রমিক অবস্থান নিয়ে সংবাদ মাধ্যমে মন্তব্য হওয়া সবে শুরু হল । এবার ধীরে সুস্থে সমাজ বিজ্ঞানীরা তলিয়ে দেখবেন রিপোর্টটা । আরেকটু বিশাদে তাৎপর্য বুঝবো আমরা।
প্রাক্তন পেশা এবং বর্তমান নেশার সূত্রের প্রথমে নজর যায় এস ডি জি ৩ এর দিকে, যে টি মুলত সুস্বাস্থ্য এবং সামাজিক কল্যাণ নিয়ে ।
আন্তর্জাতিক স্তরে এই উন্নয়নের স্থায়ী অভীষ্টে পৌঁছানোর এর জন্যে যে সূচক গুলি ধরা হচ্ছে , সেগুলো হল ,
এই সূচক পুঞ্জি নিয়ে মেলাতে চেষ্টা করছিলাম গত বছরে প্রকাশিত এস ডি জি রিপোর্টের প্রেক্ষিতে বিভিন্ন রাজ্য গুলোর মধ্যে কী ধরনে অগ্রগতি হয়েছে। প্রথমে নজরেই মনে হ'ল খুব safal হবেনা এইপ্রচেষ্টা। কারণ গত বছরে যে সব সূচক ধরে মাপা হয়েছিল, এ বছরে তার অনেক ক'টিই পরিত্যক্ত হয়েছে। আবার গত বছর রাখা হয়নি এমন কিছু সূচক এবছরে এসেছে। আমরা আগে দেখতাম দারিদ্র্য রেখার নীচে অবস্থানকারী মানুষজনদের চিহ্নিত করার সূচক কোনো দুটি পর্বে এক থাকতো না। ফলে আগের বছরের গরীব এবছরেও গরীব কি না তা বোঝাবার উপায় থাকতো না। কেবল বোঝা যেত এবছর, ওঁদের মাপ কাঠিতে কারা গরীব। এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে সংশ্লিষ্ট কর্তারা জানাতেন এটা উন্নততর সূচক, অতএব অকারনে প্রশ্ন করো না। পরে দেখেছিলাম অমর্ত্য সেন, জঁ দ্রেজ রাও এই প্রশ্ন তুলেছিলেন।
আগের বছরের সঙ্গে এবছরের সুচকগুলি যে তফাত আনা হয়েছে তা নীচের সারণিতে রাখা হ’ল।
গত বছরের SDG3 সূচক | SDG3 সদ্য প্রকাশিত রিপোর্টে ব্যবহৃত সূচক |
---|---|
মাতৃমৃত্যুর হার (MMR) (প্রতি লক্ষ জীবিত জন্মে ) | মাতৃমৃত্যুর হার (MMR) (প্রতি লক্ষ জীবিত জন্মে ) |
প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের অনুপাত | সব ধরনের প্রসবের মধ্যে কতো শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব হয়েছে |
অনূর্ধ্ব পাঁচ বছর বয়সী শিশু মৃত্যুর হার (প্রতি হাজার জীবিত জন্মে ) | অনূর্ধ্ব পাঁচ বছর বয়সী শিশু মৃত্যুর হার (প্রতি হাজার জীবিত জন্মে ) |
০-৫ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে কতো শতাংশের পূর্ণ টিকাকরণ হয়েছে | ০-৫ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে কতো শতাংশের পূর্ণ টিকাকরণ হয়েছে |
প্রতি লাখ জনসংখ্যায় কত জন যক্ষা আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা জানানো হয়েছে , | প্রতি লাখ জন সংখ্যায় কত জন যক্ষা আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা জানানো হয়েছে , |
মূল জনসংখ্যা অনুসারে প্রতি হাজার অসংক্রমিত মানুষের মধ্যে নতুন এইচ আই ভি আক্রান্তের সংখ্যা | মূল জনসংখ্যা অনুসারে প্রতি হাজার অসংক্রমিত মানুষের মধ্যে নতুন এইচ আই ভি আক্রান্তের সংখ্যা |
প্রজনন সক্ষম নারীদের (১৫ থেকে ৪৫ বছর বয়সী) মধ্যে আধুনিক পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ব্যবহারে সন্তুষ্ট জনগোষ্ঠীর হার, | এ বছর ধরা হয়নি |
প্রতি ১০ হাজার জন জনগোষ্ঠীর বিপরীতে স্বাস্থ্যকর্মীর ঘনত্ব ও বন্টন ( চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্য প্রযুক্তিবিদ ) | প্রতি ১০ হাজার জন জনগোষ্ঠীর বিপরীতে স্বাস্থ্যকর্মীর ঘনত্ব ও বন্টন ( চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্য প্রযুক্তিবিদ ) |
আত্মহত্যাজনিত মৃত্যুর হার, ( প্রতি ১,০০,০০০ জনসংখ্যা পিছু ) | |
সড়ক দুর্ঘটানায় মৃত্যুর হার ( প্রতি লাখ জন সংখ্য পিছু ) | |
সংসারে মাসিক ব্যয়ের অনুপাতে স্বাস্থ্য সেবায় ব্যয়ের অনুপাত ( সংসারে মোট ব্যয় অথবা আয়ের > ১০% ) |
তিনটি সূচক যোগ করা হ’ল। প্রশ্ন হ’ল ২৫ টা সূচকের দীর্ঘ তালিকা থেকে আগে ব্যবহৃত ন’টি তালিকা থেকে একটি বাদই বা দেওয়া হ’ল ,আর বেছে বেছে ওই তিনটিকেই বা কেন জোড়া হ’ল? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা শুরু করা যাতে পারে পুরনো গতবছরের এস ডি জি ৩ এর সুচক অনুযায়ী কনো রাজ্যের অবস্থান কোথায় সেটা এক নজরে দেখে নেওয়া, নীচের সারণিতে সেটাই করার চেষ্টাকরেছি।
সারণি ১ঃ এস ডি জি ইন্ডিয়া ২০১৯ -২০ রড্যাশ বোর্ড অনুযায়ী এস ডি জি -৩ সূচক গুলিতে বিভিন্ন রাজ্যের অবস্থান।
এই স্কোরে বাংলার অবস্থান ৮ম স্থানে। গুজরাট ৯ নম্বরে। পশ্চিমবঙ্গে মাতৃমৃত্যুর হার ৯৪, গুজরাটের ৮৭ । প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবে বাংলা গুজরাটের থেকে এগিয়েছিল। অনূর্ধ্ব পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের মৃত্যু গুজরাটে বেশি, কিন্তু টিকাকরণে গুজরাট পিছিয়ে, যক্ষা রোগ পশ্চিমবঙ্গে কম, এইচ আই ভি পশ্চিমবঙ্গে বেশি, পরিবার পরিকল্পনায় পশ্চিমবঙ্গ এগিয়ে, স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যার অনুপাতে গুজরাটে অনেক বেশি। সবমিলিয়ে এস ডি জি তিন এর সূচকে পশ্চিমবঙ্গের স্কোর ৭০ এবং গুজরাটের ৬৭।
এবার আমরা এইবছরের সূচক গুলোর ভিত্তিতে রাজ্য গুলির নতুন Ranking টা দেখবো ।
সারণী২ঃ এস ডি জি ইন্ডিয়া ২০২০ -২১ রড্যাশ বোর্ড অনুযায়ী এস ডি জি -৩ সূচক গুলিতে বিভিন্ন রাজ্যের অবস্থান।
নতুন সূচক তিনটে জুড়তেই গুজরাট একলাফে দ্বিতীয় স্থানে পৌঁছেগেল। গুজরাটের স্কোর , এস ডি জি ৩ এর ক্ষেত্রে , একলাফে ৬৭ থেকে বেড়ে ৮৬। গুজরাটে মাতৃমৃত্যুর হার এক বছরেই কমে এল ৭৫, পশ্চিমবঙ্গে এটা ৯৮ রয়ে গেল। অনূর্ধ্ব পাঁচ বছরে শিশুমৃত্যু নেমে এসেছে ৩১ (পশ্চিমবঙ্গ ২৬) এ। সম্পূর্ণ টিকা করণে গুজরাট ৮৭ (পশ্চিমবঙ্গ ৯৭), টিবি নোটিফিকেশনে গুজরাট ২৩২ (পশ্চিমবঙ্গ ১১১), এইচ আই ভি তে গুজরাটে ০.০৫ (পশ্চিমবঙ্গে ০.০৪)। নতুন সূচক আত্মহত্যার ক্ষেত্রে গুজরাটের ১১.২ পশ্চিমবঙ্গের ১৩ –র চেয়ে কম। সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে ও গুজরাটের ১০.৮৮, পশ্চিমবঙ্গের ৫.৮৯ এর চেয়ে বেশি। প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবে গুজরাট ৯৯.৫ পশ্চিমবঙ্গের ৯৮.৬ এর একটু ভাল। স্বাস্থ্যখাতে মাসিক আয়ের ৯.৫ শতাংশ ব্যয় হয় যা পশ্চিমবঙ্গের ১৬.৯ শতাংশের চেয়ে বেশ অনেকটা কম।
যে তথ্যটি অবাক করে তাহ'ল প্রতি ১০,০০০ জনসংখ্যায় ৪১ জন সবধরনের স্বাস্থ্যকর্মী থাকা সত্ত্বেও গুজরাট বেশ কয়েকটি সূচকে ১০,০০০ প্রতি ২৭ জন স্বাস্থ্যকর্মী থাকা পশ্চিমবঙ্গের পেছনে।
দ্বিতীয় প্রশ্নটা ওঠে সূচক নির্বাচন নিয়ে। আগের বারের সূচকের সঙ্গে কি কেবল বেছে বেছে সেই সূচকগুলো কেই নেওয়া হ'ল, যা গুজরাটকে ভারতসভায় শ্রেষ্ঠ আসন দেবে ?
যে কাজটা আমরা এক্ষুনি করে উঠতে পারলাম না, অথচ করা খুব দরকার, সেটা হ’ল আন্তর্জাতিক তালিকা ভুক্ত ২৫টি সূচক ধরেই রাজ্যগুলির অবস্থান দেখার চেষ্টা করা। আশা করি সমাজ বিজ্ঞানীরা নাড়াচাড়া শুরু করবেন বিষয়টিকে ,সমগ্র রিপোর্টের যাবতীয় তথ্যই যাচাই করবেন তাঁরা।
আপাতত প্রাইজের নিয়ম পালটে গুজরাট নামক ‘খুদিরাম’ পশ্চিমবঙ্গ নাম কনন্দলালকে পেছনে ফেলেছে।
সুস্বাস্থ্যের বিষয়ে সবধরনের প্রতিযগি প্রতিযোগিতাই আমাদের মতো আমজন তার কাছে স্বাগত, যতক্ষণ সেটা সঠিক তথ্য ভিত্তিক থাকে।